মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫, ০৫:১৮ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
ঈদ- অভিধানের এ শব্দটাই যেন খুশিতে মাখা। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা দীর্ঘ এক মাস রোজা ব্রত পালনের পর পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করেন। যুগ যুগ ধরে তা এক শাশ্বত ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক। রমজানের সিয়াম সাধনার পর মহোৎসবের মিলনের বাণী নিয়ে এবারও উপস্থিত ঈদ। তবে পফশ্চম সংস্কৃতির ঠেলায় নাকি আধুনিকতার ছোঁয়ায় ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম এ উৎসবের মাহাত্ম্য যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। বেশীদিন নয়, প্রায় তিন দশক আগের ঈদ উদযাপন আর বর্তমান সময়ের ঈদ উদযাপনের মধ্যে বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইসলাম ধর্মাবম্বীদের ঐতিহ্যপূর্ণ এ উৎসব যে আজ খেই হারাতে বসেছে তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। যে দেশে রমজানের শেষের দিকে ঈদের সপ্তাহ খানেক বাকি থাকতেই একটা ফুর্তির ফোয়ারা বয়ে আসতো। ঈদের চাঁদ দেখার অনেক আগেই গ্রামের মহিলারা নিজের হাতে তৈরী করতেন দড়ির মতো লম্বা ময়দা বা আটার সেমাই। আজ সে-স্থান নিয়েছে নামী দামি সেমাই কোম্পানী। সেমাই বলতে বর্তমান প্রজন্ম এটাকেই চিনে। বাড়ীঘর ঝাড়পোছ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, সামর্থ অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা চাঁদ দেখার অনেক আগেই শুরু হয়ে যেত। অবশ্য এক্ষেত্রে তেমন ব্যতিক্রম হয়নি আজও।
এবার আসা যাক চাঁদ দেখার প্রসঙ্গে- আগেকার দিনে বলতে গেলে সেদিন রমজানের শেষদিনে সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার ধুম পড়ে যেত। শাওয়ালের একফালি বাঁকা চাঁদের দর্শনেই যেন ঈদ-উল-ফিতরের সব আনন্দ-ফুর্তি লুকিয়ে থাকতো। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ উৎসাহ ছিল প্রবল। ত্রিশতম রমজানের ইফতারটা সেরেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই, ঘরের ছাদে বা কোন উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশের পানে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন উৎসুকরা। কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবারই শাওয়ালের চাঁদ এক ঝলক দর্শন পেতে কত না কসরত। যারা চাঁদ দেখতে পেতেন তাঁরা কত ভাগ্যবান আর যারা দেখলেন না তারা নিজেকে হতভাগ্যই মনে করতেন। ঈদের চাঁদ দেখার পর চাঁদকে সালাম, বিশেষ করে মোনাজাত সহ আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ত শিশু-কিশোররা। চাঁদ দেখার পর থেকেই গুরুজনদের সালাম করার রেওয়াজ ছিল সে-কালে। আর এ সময়ে ঈদের চাঁদ দেখা কার্যত অলীক স্বপ্ন। এ প্রজন্মের ক’টা ছেলেমেয়ে চাঁদ দেখার আনন্দ উপভোগ করে তা বলা মুশকিল। বর্তমান সময়ে ফি বছরই ঈদ-উল-ফিতরের দিন নিয়ে এক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কেউ বলেন অমুক দিন, কেউ বলেন তমুক দিন। ঈদের সঠিক দিন ঘোষণার জন্য সরকারের নির্ধারিত কমিটির পানে চেয়ে থাকি আমরা। নিজের চোখে চাঁদ না দেখায় পরদিন রোজা রাখার প্রস্তুতি নিয়ে তারাবির নামাজ পড়ে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন সবাই। অবশেষে রাত বারোটার পর মাইক যোগে ঘোষণা হল ‘ঈদ মোবারক’। ভেবে দেখুন কি পরিস্থিতিতে না পড়তে হয় সবাইকে! অধিকাংশই এক অপ্রস্তুত অবস্থায় পরদিন ঈদ পালন করেন। এতে ঈদের সব আনন্দই কার্যত ম্লান হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও দ্বিমত থাকে। কেউ ঈদ পালন করছেন আবার কেউ পরের দিন ঈদের নামাজ আদায় করছেন। যার জ্বলন্ত উদাহরণ গেল বছরের ঈদ-উল-ফিতর। অথচ সে-কালে ঈদের পূর্ব সন্ধায় মসজিদে মসজিদে মাইকযোগে ঘোষণা হতো শাওয়ালের চাঁদের আবির্ভাবের কথা। মা, বাবা, দাদা, দাদীর কাছে শুনেছি, তাদের সময়ে ঈদের চাঁদ দেখার পরপরই শুরু হয়ে যেত বয়োজ্যেষ্ঠদের সালাম করার প্রথা। ঈদের দিন ভোরবেলা উঠেই সবাই গোসলটা সেরে নিতেন। এরপর শুরু হতো দানপর্ব। কেউ আবার গরীব দুঃস্থদের মধ্যে চাল বন্টন করতেন। প্রতিটি বাড়ীতে শত শত ভিখারি এসে হাজির হতো। ফিতরাটা ঈদের নামাজের আগেই শেষ করা বাধ্যতামূলক। সে রীতি অবশ্য আজও আছে। বাড়ীঘর ঈদের দিনে সাজিয়ে নতুন রূপ দেওয়ার প্রয়াস থাকত, এমনকি গ্রামাঞ্চলে গৃহপালিত গো-মহিষকেও ঈদ উপলক্ষে গোসল করানো হতো। আগেকার দিনে দু’তিনটি গ্রাম মিলে এক একটি ঈদগাহে ঈদের জামাত হতো। কিন্তু আজ অধিকাংশ গ্রামেই মসজিদে মসজিদে ঈদের জামাত হতে দেখা যায়। অবস্থানুসারে লুঙ্গি, পাজামা, পাঞ্জাবী বা শার্ট গায়ে দিয়ে ধনী-গরিব সবাই ঈদের জামাতে সামিল হতেন। ছোট ছোট শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা রং-বেরঙ্গের জামাকাপড় গায়ে দিয়ে ছুটোছুটি করতো। চোখে রঙ্গিন চশমা আর মুখে মিষ্টি পান। বাড়ী বাড়ী গিয়ে বড়দের সালাম করে ‘ঈদি’ সংগ্রহ করত। আর আজকের প্রজন্ম ঈদের দিনে রাস্তায় বেরিয়ে দু’তিন চক্কর কেটে দোকান থেকে খাচ্ছে শিখর, হরপল ব্রান্ডের গুটকা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঈদের দিনে বড়দের সালাম করার রীতিটা আজকাল কমে যাচ্ছে। এমনকি অনেক ছেলেমেয়ে তাদের মা-বাবাকে পর্যন্ত সালাম করতে দ্বিধাবোধ করে। অথচ তা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেরই অজানা। যুব প্রজন্ম, এদের একাংশের কথা তো আর বলে লাভ নেই। ঈদের নামে হৈ-হুল্লুড়, গানবাজনা যতসব ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকতে দেখা যায় কিছু যুবক যুবতীকে। এটা কিন্তু আগে ছিল না।
সে-কালে ঈদের দিনে খাবার দাবারের ব্যাপারটাই ছিল এক ভিন্ন মাত্রার। ঈদের দু’দিন আগেই তৈরী করা হতো চালের গুঁড়ো। ঈদের আগের রাতে সারা রাত জেগে মা, দাদীরা তৈরী করতেন চালের গুঁড়ো আর ময়দার সুস্বাদু মিষ্টান্ন। তাদের হাতে তৈরী নানা স্বাদের পিঠেপুলি ঈদের এক অনন্য বার্তা বহন করতো। কিন্তু আজকাল গ্রাম বলুন আর শহর বলুন অনেকেই কিন্তু দারুণ মডার্ণ এবং আর্টিফিসিয়াল। কে করতে চায় এসব ঝামেলা। কিছুটা সচ্ছল যারা, তাদের পরিবারে পিঠেপুলির জায়গাটা দখল করেছে বিভিন্ন কোম্পানীর দোকানের রকমারি মিষ্টি। আর ঘরে তৈরী মুরগি-পোলাও এর স্থান নিয়েছে নামিদামী কোন রেস্টুরেন্টের চিকেন বিরিয়ানি বা চাইনিজ ডিস। এসব অবশ্য একাংশের শহুরে কালচার। যে সময়ের কথা আলোচনায় ওঠে এসেছে তখন ঈদের দিনে নামাজ শেষে কিশোর-যবকদের পাশাপাশি বয়স্কদেরও দলবদ্ধভাবে এবাড়ী-ওবাড়ী বেড়াতে যেতে দেখা যেত। পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গ্রামে, বাড়ীতে-বাড়ীতে বা একে অপরের মধ্যে যদি কোন মনোমালিন্য থাকতো তবে ঈদের দিনেই তা মিটে যেত। কোলাকুলি, একে অন্যের মোবারকবাদ বিনিময়ের মাধ্যমেই সৌহার্দের সুবাস সৌরভিত হতো পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গ্রামে। আর আজকের যুগে আধুনিকতার বদান্যতায় মোবারকবাদটা সেরে নেওয়া হচ্ছে এসএমএস এর মাধ্যমে। যুগ পাল্টে যাচ্ছে। পাশাপাশি ঈদের খুশি উপভোগ বা ঈদ পালনের ধরনটাও ক্রমে পরিবর্তনের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
শুধূ তাই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো শান্তির দ্বীপ বলে খ্যাত আমাদের দেশে আজ জীবণ যন্ত্রণা বেড়েছে। জীবনের ঘাটে ঘাটে আমরা ধুঁকে মরছি। এর পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় গ্রাম-শহরের পরিমন্ডল বিস্তৃত হয়েছে বা হচ্ছে। শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের দৌলতে গ্রাম আজ অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। ঈদের আনন্দ উপভোগ আর অন্যান্য আনুষঙ্গিকতায় প্রাচীণ ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই অনুপস্থিত। গ্রাম বলুন আর শহর, রমজানের শেষে ঈদ উদযাপনের অনুষ্ঠানকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই আজ অন্য চোখে দেখেন। উত্তরোত্তর গ্রামীণ অনুষ্ঠানেও হাওয়া লেগেছে আধুনিক সভ্য সমাজের সোনালি পরিচর্যার। ফলে আজকের দিনে শহর বলুন আর গ্রাম, সর্বত্রই ঈদ উদযাপিত হচ্ছে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। শিক্ষা-দীক্ষা, মতি-গতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মানুশীলন ও উৎসব উদযাপনের রীতি-নীতি ও চিন্তা-চেতনার সূত্রের খেইও নবযাত্রার পথ খুঁজে পাচ্ছে। এ ঈদ উদযাপনের মধ্যেও আজ শতধারায় প্রবাহিত হয়ে চলছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কারের ফলশ্র“তি। বিশ্বায়নের এ যুগে ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্যবাহী ঈদ উৎসব আরেক নতুন মাত্রায় সমৃদ্ধি অর্জনে সদা জাগ্রত এবং সতত প্রতিক্রিয়াশীল। আসুন শাশ্বত ঐতিহ্যের তথা মহামিলনের এ উৎসবকে আরও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা সচেষ্ট হই। সাংবাদিক ও কলামিস্ট।.০৪.০৪.২০২৪